ইনসাফপূর্ণ সমাজ বিনির্মান মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব -আবু নাঈম

সকলের খবরসকলের খবর
  প্রকাশিত হয়েছেঃ  ০৫:৫৭ PM, ১৪ মার্চ ২০২৫

প্রতিটি মানুষ চায় এমন সমাজের অধিবাসী হতে যে সমাজ অন্যায়, অবিচার,জুলুম,শোষণ ও বৈষম্য থেকে মুক্ত। সমাজের প্রতিটি স্তরে সাম্য, সততা মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।মানুষ তার মৌলিক অধিকার যেমন-জীবন, সম্পদ, মত প্রকাশ ও ধর্মীয় স্বাধিনতা নিয়ে কুণ্ঠিত হবেনা। আইনের শাসনে থাকবে সততা ও স্বচ্ছতা, বিচারকগণ নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারবে, ধনী গরীবের বৈষম্যে গরীবদের বুকফাটা বা চাপা কান্না থাকবেনা। সকলের মুখে থাকবে আনন্দের হাসি। অনেকের মনে হতে পারে এটা এক অবাস্তব কল্পনা। এমন সমাজ বিনির্মান একেবারেই অসম্ভব। এমন ধারণা পোষণকারীদের জন্য

পৃথিবীর কয়েকটি ইনসাফপূর্ণ সমাজের উদাহরণ তুলে ধরছি :-

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মদিনার ইসলামি রাষ্ট্র: নবী মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় একটি ইনসাফপূর্ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে মুসলিম ও অমুসলিম সকলের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষিত ছিল। খলিফা ওমর (রা.)-এর শাসন: ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.)-এর শাসনকালকে ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসে এখনো সমাদৃত। উমাইয়া ও আব্বাসীয় খেলাফতের সুবর্ণ যুগ: বিজ্ঞান, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে এই যুগকে ইনসাফপূর্ণ সমাজের আদর্শ উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়।

উমর ইবনে আবদুল আজিজ-এর শাসন: যাকে ইসলামের ইতিহাসে পন্ঞ্চম খলিফা বলা হয়ে থাকে। যার শাসনকাল ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের এক অনন্য দৃষ্টান্ত । এই সমাজগুলো প্রমাণ করে যে ইনসাফপূর্ণ সমাজ গঠনের জন্য ন্যায়বিচার, সততা ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হয়। আর এমন সমাজ বিনির্মানের জন্য আমাদের আদর্শ নেতা নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দায়িত্ব দিয়ে এ দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন।

আল্লাহ রাব্বুল বলামিন বলেন :

তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি তাঁর রসূলকে হিদায়াত এবং ‘দ্বীনে হক’ দিয়ে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি এ দ্বীনকে অন্য সকল দ্বীনের ওপর বিজয়ী করেন, চাই তা মুশরিকদের কাছে যতই অসহনীয় হোক না কেন। (আস-সফ, আয়াত: ৯)

আল্লাহর নবী হযরত ঈসা (আঃ) থেকে নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) নবুয়ত প্রাপ্তির মধ্যখানে ৬ শত বছরের ব্যাবধান। এসময়ে মানুষ শয়তানী কাজে এত বেশী আসক্ত ও অব্যস্ত হয়েছিল। যার কারনে সমাজের শান্তি প্রিয় মানুষ গুলো অজ্ঞতা, পাপাচার ও জাহেলিয়াতের ছোবলে থেকে নিজেদের বাঁচাতে দিক বিদিক ছুটোছুটি করছিল। ঠিক সে সময়ে মানুষদেরকে সত্য পথের দিশা দিয়ে অজ্ঞতা, পাপাচার ও জাহেলিয়াত থেকে মুক্ত করতে নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা জগতের জন্য রহমত হিসেবে পাঠিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন— “আমি তোমাকে সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত হিসেবে পাঠিয়েছি।” — (সুরা আল-আম্বিয়া: ১০৭)

আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব ও বিধানের আলোকে তিনি একটা ইনসাফপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এবং তার দেখানো পথ ও প্রদ্ধতি অনুসরণ করেই দুনিয়াতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মানুষদের মধ্যে যারা ঈমানদার ও মুসলমান পরিচয় দেয়। তাদের কাজ হচ্ছে আল্লাহ গোলামী করার পাশাপাশি আল্লাহর দেওয়া পরিচয় খলিফা হিসাবে ইনসাফপূর্ণ সমাজ বিনির্মানে আত্মনিয়োগ করা। এটা কোন নফল কাজ নয় এটা আল্লাহ নির্দেশ যে কাজ স্বয়ং নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) করেছেন।

মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে- আর যা আমি ওহী করেছি আপনাকেএবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসাকে, এ বলে যে, তোমরা দীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে দলাদলি-বিচ্ছিন্নতা করো না।

আল্লাহ দেওয়া বিধান এর আলোকে বিচার ফয়সালা করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন : আর যারা আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী ফায়সালা করে না তারাই ফাসেক। (আল-মায়িদাহ, আয়াত: ৪৭)

আল্লাহর বিধানের আলোকে বিচার ফয়সালা করতে হলে দ্বীন কায়েম থাকা জুরুরি। কারণ দ্বীন হীন কায়েমি স্বার্থবাদীরা কখনো ইনসাফ করতে পারেনা। সেজন্য আল্লাহর এ বিধানকে যিনি ফরজ মনে করতে পারবেন না তার পরিচয় কি তা এ আয়াতে আল্লাহ বলে দিয়েছেন। আর আল্লাহর বিধানের আলোকে সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু সাচ্চা মুসলমান ও দৃঢ় মনোবল সম্পন্ন খালেস লোকের প্রয়োজন। যারা হবেন দাঈ ও সংগঠক।

দাঈ বা আহবানকারী :

দাঈ আরবি শব্দ যার অর্থ আহ্বানকারী, inviter, caller’ যিনি মানুষকে কোন কিছুর দিকে আহবান করেন। তবে ফাতিমীয় খিলাফতের যুগ থেকে দাঈ শব্দটি দ্বীন ইসলামের দিকে আহবান কারী ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্ট করে বুঝানো হয়। দাঈ মানেই দাঈ ইলাল্লাহ। যিনি মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকেন। দাঈ তার প্রজ্ঞা, উত্তম উপদেশ ও সুন্দর যুক্তির মাধ্যমে মানুষকে ইসলামের সুমহান আদর্শের দিকে আহবান করা।

যেমন আম্বিয়া আলাইহিসসালামগন করে ছিলেন। নবী মুহাম্মাদ সাঃ এর উপর যখন আয়াত নাযিল হয়- (১) হে বস্ত্র আচ্ছাদানকারী (২) ওঠো এবং সতর্ক করো (৩) এবং তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব বা মহত্ব ঘোষনা করো (৪) আর তোমার পোশাক পবিত্র রাখো (৫) অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো (৬) অধিক প্রতিদানের আশায় কারো প্রতি অনুগ্রহ করো না (৭) এবং তোমার রবের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করো। (সুরা মুদ্দাসিসর ১-৭)

রবের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা মানে আল্লাহ তার নবীকে বলছেন তাওহীদের দাওয়া দাও।  আল্লাহ আশ-শু‘আরা ২১৪ নং আয়াতে বলেন : ‘‘আর তুমি সতর্ক কর তোমার নিকটাত্মীয় স্বজনদের এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ সাঃ সাফা পাহাড়ের উপরে উঠে সবাইকে ডাকলেন এবং সতর্ক করলেন।

হযরতে ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন : নাবী কারীম (সাঃ) সাফা পর্বত শিখরে আরোহন করে কুরাইশ গোত্রের সকলকে লক্ষ্য করে বিশেষ কিছু শব্দ উচ্চারণ করে চিৎকার করতে থাকলেনঃ  ‘‘ওহে বনু ফিহর! ওহে বনু আদী! (ওহে বনু অমুক, ওহে বনু ওমুক, ওহে বনু আবদে মানাফ, ওহে বনু আবদুল মুত্তালিব)

এভাবে সকলকে ডেকে একসাথ করেন এবং উপস্থিত সকলের নাবী কারীম (সাঃ ) বললেন, ‘‘হে কুরাইশ বংশীয়গণ! তোমরা বল, আজ (এ পর্বত শিখরে দাঁড়িয়ে) যদি আমি তোমাদিগকে বলি যে, পর্বতের অন্য দিকে এক প্রবল শত্রু সৈন্য বাহিনী তোমাদের যথা- সর্বস্ব লুণ্ঠনের জন্য অপেক্ষা করছে তাহলে তোমরা আমার এ কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে কি? সমবেত সকলে একসাথে বললেন নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবো। কারণ তুমি কখনো মিথ্যা বলোনি আর মিথ্যার কাছেও যাওনি। বলো আমরা শুনি :এরপর রাসুল ধীরস্থির ভাবে বলতে লাগলেন।

যদি তাহাই হয়, তবে শুনুন। আমি আপনাদেরকে অবশ্যম্ভাবী কঠোর শাস্তি কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছি ….। অতঃপর সাধারণ ও বিশেষভাবে সকলকে সত্যের পথে আহ্বান জানালেন এবং তাদেরকে আল্লাহর কঠিন শাস্তির ভয় প্রদর্শন করে বললেন। তিনি প্রতিটি গোত্রের নাম ধরে ধরে বলতে লাগলেন “তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা কর এবং তোমাদের নিজেদেরকে আল্লাহর নিকট সঁপে দিয়ে তার সন্তুষ্টি অর্জন করো।”

ইনসাফপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা প্রথম দাফ হচ্ছে সে সমাজের মানুষকে শির্ক মুক্ত আল্লাহর গোলামীর জন্য তৈরী করা।  এবং তা শুরু করতে হয় নিজ পরিবার ও কওমের লোকদের দাওয়াত দানের মাধ্যমে।

দাঈর মর্যাদা : মানুষকে সত্য ও সঠিক পথের দিশা দিতে দাঈ ব্যক্তির সার্বক্ষণিক চিন্তায় থাকে আল্লাহর দ্বীন প্রচারে । নিঃসন্দেহে এ কাজ অত্যন্ত মহৎ,মর্যাদাপূর্ণ এবং লাভজনক।

আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর তার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, সৎকর্ম করে এবং বলে, ‘নিশ্চয়ই আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত’?” (সূরা ফুস্সিলাত: ৩৩)

আল্লাহর গোলামীর দিকে আহবান কারী ব্যক্তির দাওয়াতে কেউ যদি ইসলামী অনুশাসন মেনে চলা শুরু করেন তাহলে দাঈর এর জাজা পেতে থাকবেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—

“যে লোক সঠিক পথের দিকে ডাকে তার জন্য সে পথের অনুসারীদের প্রতিদানের সমান প্রতিদান রয়েছে। এতে তাদের প্রতিদান হতে সামান্য ঘাটতি হবে না। আর যে লোক বিভ্রান্তির দিকে ডাকে তার উপর সে রাস্তার অনুসারীদের পাপের অনুরূপ পাপ বর্তাবে। এতে তাদের পাপরাশি সামান্য হালকা হবে না। না।” (সহিহ মুসলিম: ২৬৭৪)

মর্যাদাপূর্ণ কাজটি করতে আল্লাহ বহু আয়াতে নামান ভাবে মো’মিনদের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন: এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম দল। তোমাদের কর্মক্ষেত্রে আনা হয়েছে মানুষের হিদায়াত ও সংস্কার সাধনের জন্য। তোমরা নেকীর হুকুম দিয়ে থাকো, দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহ‌র প্রতি ঈমান আনো। (আলে-ইমরান, আয়াত: ১১০)

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন তোমরা যা জানো তা অন্যের কাছে পৌছিয়ে দাও। “আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হলেও (মানুষকে) পৌঁছে দাও।” আল্লাহ ও রাসুল সাঃ এর নির্দেশিত এ মহান কাজটিতে যারা নিয়োজিত থাকেন। তাদের জন্য আল্লাহর অন্যান মাখলুকরা দোয়া করতে থাকেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— “আল্লাহ তাআলা, তাঁর ফেরেশতারা, আসমান ও জমিনের সকল সৃষ্টি এমনকি পিঁপড়া ও মাছ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির জন্য দোয়া করে, যে মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করে এবং ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করে।” (জামে তিরমিজি: ২৬৮৫, সহিহ)

চলবে —-

লেখক : আবু নাঈম মু শহীদুল্লাহ্,  সভাপতি :সিআরসিআইপিটি ( CRCIPT)

আপনার মতামত লিখুন :