রাষ্ট্রকে মায়ের মতই সর্বংসহা হতে হয়, হতেই হবে!

মীর হালিম। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২০২৪”কে ঘিরে কয়েকটি জ্যামিতিক স্বতঃসিদ্ধ লিপিবদ্ধ করিলাম!
১. বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন বর্তমানে শুধু কোটার ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসনের জন্য আন্দোলন করছে। আগামী দিনে বাংলাদেশে রাষ্ট্র মেরামতের কাজ তারা, তাদের উত্তরসূরীরা কিংবা তাদের সমর্থনকারীরাই করবে।
২. কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রথমত মুক্তিযোদ্ধা বা ছাত্রলীগের বিপক্ষে কোন আন্দোলন নয়। পাবলিক পলিসির বিষয়ে সরকারের উদাসীনতার ফলাফল। “মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কটাক্ষ করাটা অপরাধ” এটা বুঝে বলেই তারা মেধাবী। ছাত্রলীগের পদধারী অনেকেই পদত্যাগ করেছে, পদহীন কর্মী বা সমর্থকরা হয়তো গোপনে কোটা সংস্কারের পক্ষে যোগ দিয়েছে বলেই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা এত বেশি! কোটা পদ্ধতির সংস্কার করে বিদ্যমান হার কিছুটা কমিয়ে ও কোটা নিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ করলে আজকে হয়তো লাশের মিছিল দেখতে হতো না! সমাজের অনগ্রসর অংশ বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বা জাতিগুষ্টির জন্য প্রয়োজনে বিশেষ সুবিধা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, এ কথাটি মেধাবীরাই আবিষ্কার করেছে!
৩. ডানপন্থী, বামপন্থী, মধ্যপন্থী বা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী সকলেই আজ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একই ধ্যানের মৃণাল ধরিয়া বিকশিত হয়েছে! বোরকা পরা মেয়েটির পাশেই টি-শার্ট পরা আধুনিকা, টুপি পরা নামাজি ছেলেটির পাশেই শাহবাগের মোড়ে বা চারুকলায় চুরুট খাওয়া শিল্পীরা!বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সংহতি জানাচ্ছে! নিকট অতীতে এমনটি ৫২, ৭১ কিংবা ৯০ হয়েছিল!
বিপরীতমুখী মানুষগুলোর দাবি কেন এক হয়ে গেল এটা কি ভাবনার বিষয় নয়?
৪. পুলিশ বাহিনী বড় অসহায় হয়ে পড়েছে। তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এভাবে পেটাতে চায় না। তারাও পিতা তারাও ভাই তারাও কারো আত্মীয় স্বজন! দিনশেষে বাসায় গিয়ে দেখে তার সন্তান আহত হয়ে বাসায় কাতরাচ্ছে আর যত্ন করছে মা! ছেলের একটিই কথা আগামীকালও সে তার বন্ধুদের সাথে যোগ দিবে! এমন কাঁচা সবুজ অবুঝ ছেলের গায়ে কি বাবা হাত তুলতে পারে?
৫. মাঠ পর্যায়ে সাংবাদিক ভাইয়েরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, মার খেয়ে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচার করছে। বুদ্ধিজীবীদেরকে এই ব্যাপারে ইতিবাচক বা নেতিবাচক খুব বেশি লেখালেখি করতে দেখতেছি না! বিবেকবান ও ন্যায়পরায়ণ সাংবাদিকদের কলম আজ কোথায়?
৬. বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আওয়াজ আশাকরি আদালতে পৌঁছেছে! আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ইচ্ছাকে কমিশন গঠন বা আইন প্রণয়নের সুপারিশের মাধ্যমে ফিরিয়ে দিলে কেমন হয়? এমিকাস কিউরি বা সমাজ বিশেষজ্ঞরা মতামত দিবেন কি? ছাত্রদের দাবির সমান্তরাল ন্যায়বিচার না হলে তারা মানতে চাবে কি? আদালত না সংসদ! এ বিষয়গুলি আরো জানতে মন চায়!
৭. যারা বৈষম্য গড়েছে বা টিকিয়ে রেখেছে তারা বৈষম্য নিরসন করতে চাইবে না! কান্নার মাধ্যমে সংকেত না দিলে প্রিয় মা জননীও সন্তানকে খাবার দেয় না! ধৈর্য ধরে যুক্তির সাথে বৈধ উপায়ে আন্দোলন চালিয়ে গেলে হয় এই সরকার না হলে পরবর্তী সরকার দাবি মানতে বাধ্য হবে!
৮. পৃথিবীর জীবনাচরণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফেয়ার না! বৈষম্য ছিল আছে হয়তো থাকবে। রাষ্ট্রশক্তিগুলো কিংবা জাতিপুঞ্জ নানা ছলে বলে কিংবা ভুলে কৌশলে বৈষম্য টিকিয়ে রাখে! মেধাবীদের দায়িত্ব যতটুকু সম্ভব বৈষম্য নিরসন করা ! ন্যায় ও নায্যতার ভিত্তিতে রিস্ট্রিবিউশন করা! তাদের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকা! আজকে যা বলছি ও বিশ্বাস করছি আগামী দিনে তা কার্যে পরিণত করা!
৯. জাতির বিবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নীরবতা জাদুকর জুয়েল আইচের নাটক ভয়ংকর সুন্দরের মত! আসিফ নজরুল স্যারসহ যারা নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষক সমাজের ব্যানারের সংহতি প্রকাশ করেছেন তারা ব্যতিক্রম, তারা ভেঙেছেন বাঁধার বিন্দাচল! তারা করেছেন অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস! আগামী দিনে বৈষম্য বিরোধী ছাত্ররা আপনাদের দাবি সর্বজনীন পেনশন নীতিমালা নিয়ে লড়বে! আপনাদের পাশে থাকবে! আজ যারা বোবা বধির তাদের পক্ষেও লড়বে! কোমলমতি ছাত্রদের স্বভাব সত্যের পক্ষে লড়া! আগে তারা প্রযুক্তি, প্রেম, বিরহ বুঝত! এখন দেখি তারা জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ পড়ে দ্রোহও বুঝতে শিখে যাচ্ছে! আসছে ফাল্গুনে তারা নাকি আবার দ্বিগুণ হবে!
১০. এই মুহূর্তে খুব প্রাসঙ্গিক না হলেও একটি স্বপ্নের কথা বলে রাখি! নতুন দিনের প্রথম কাজ হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীকে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ লাইব্রেরীতে পরিণত করা! বইয়ের সংগ্রহ ও অবকাঠামগত! যে বইটি আজ নিউইয়র্ক, লন্ডন, মস্কো, প্যারিস, রোম, বেইজিং টোকিও বা কুয়ালালামপুরে প্রকাশিত হবে তার পরদিন বা সবচেয়ে কম সময়ে চলে আসবে এই লাইব্রেরীতে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছেন, জীবিত আছেন! এমন ভাইবোনেরা মাত্র ১০০০ করে টাকা দান করলে এই স্বপ্নটি পূরণ হয়ে উদ্বৃত্ত থাকবে বলেই মনে করি! আচ্ছা ভাইয়েরা পি কে হালদার কিংবা বেনজির ভাইয়ের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এই কাজ করলে কেমন হয়? আমাদের ভাগ্য আমরাই গড়িয়া লইব! পদ্মা মেঘনা যমুনা সুরমা ব্রিজ হয়তো আমাদের দরকার, মেট্রো রেলও হয়তো দরকার, তার চেয়েও আগে দরকার এমন একটি লাইব্রেরীর!
১১. সরকার সবল হলে আলোচনা করত, কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে ব্যালান্স করত! দুর্বল বলেই গুলি করে, মামলা দেয়! আমি বিশ্বাস করি কোটা পদ্ধতি যৌক্তিক ভাবে সংস্কার করলে ছাত্ররা ক্লাসে ফিরে যাবে! কোটা পদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল করাটাও যুক্তিসিদ্ধ বলে মনে হয় না। রাষ্ট্র তার নীতি প্রণয়নে মমতার পরিচয় দিতে হবে! মায়ের ভূমিকা পালন করতে হবে! কর্মঠ ছেলেটির প্রতি যেমন যত্ন নেয় একইভাবে অসুস্থ বা প্রতিবন্ধী সন্তানের দিকেও নজর রাখে মা!
রাষ্ট্রকে মায়ের মতই সর্বংসহা হতে হয়, হতেই হবে!
প্রিয় বিজ্ঞজনেরা আপনাদের মতামত জানতে চাই!
বিনয়াবত
মীর হালিম
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও পাবলিক পলিসি অ্যানালিস্ট।